মুহা. আবুযর গিফারী মোল্লা
শিক্ষাবর্ষের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শিক্ষকগণ শ্রেণি কক্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে শিখন শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করেন। শিক্ষার্থীদের শিখন যাচাই করা হয় পরীক্ষার মাধ্যমে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভীতি দূর করার বিষয়কে অধিক গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে পরীক্ষা পদ্ধতির মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা মূল্যায়নের জন্য যে পদ্ধতি বা কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে, পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ।
শিক্ষার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়নে শিক্ষকগণের স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ রয়েছে। কোন শিক্ষক তার খেয়ালখুশি অনুযায়ী শিক্ষার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়ন করলে সেটা হবে অবমূল্যায়ন। শিক্ষার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত লিখিত উপাদানের অভাবে তদন্ত করেও স্বে”চাচারী শিক্ষকে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না। এই পদ্ধতিতে টার্গেট করে যে কোন শিক্ষককে কর্তব্য কাজে অবহেলার ফাঁদে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে।
বাংলাদেশে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচলিত বা সনাতনী যে পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর পরীক্ষা হতো তাতে শিক্ষার্থীকে হলে বসে পরীক্ষার খাতায় প্রশ্নের উত্তর লিখতে হতো। কঠোর গোপনীয়তার ভিতর দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন ও পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীর হাতে তা পৌঁছানো হতো। পরীক্ষা সমাপ্ত হলে কোডিং করে উত্তরপত্র ও রুব্রিক্স পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হতো। পরীক্ষক রুব্রিক্স অনুযায়ী শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতেন। পরের ধাপে শিক্ষার্থীর উত্তরপত্র ডিকোডিং করে প্রাপ্ত নম্বরকে আমলে এনে ফলাফল প্র¯‘ত করা হতো। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরীক্ষার উত্তপত্র শিক্ষার্থীদের দেখার সুযোগ দেয়। প্রাপ্ত নম্বর নিয়ে শিক্ষার্থীর সন্দেহ সংশয় দূর হয়। শিক্ষার্থী কোন প্রশ্নের উত্তর কেমন লিখেছে, কোথায় অসঙ্গতি থাকলে পরীক্ষক উত্তরপত্রে যথাযথ ফলাবর্তন করেন। এতে শিক্ষার্থীর শিখন আরো জমবুত হয়।
নতুন শিক্ষাক্রমে মূল্যায়ন হচ্ছে দুই স্তরে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও সামষ্টিক মূল্যায়ন। শ্রেণি কক্ষে পাঠদানের পাশাপাশি বিষয় শিক্ষক ধারাবাহিক মূল্যায়ন গ্রহণ করে থাকেন। সামষ্টিক মূল্যায়নের দিকনির্দেশনা ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, বাংলাদেশ’ মূল্যায়ন উৎসবের সপ্তাহ দুয়েক আগেই মাধ্যামিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করেছে। যা প্রশ্ন ফাঁসের নামান্তর।
এর দায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের উপর বর্তায়। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা দলগতভাবে একটি কাজ করবে। দলে মৌখিকভাবে আলোচনা করবে। দলনেতা দলীয় কাজ সবার সামনে উপস্থাপন করবে। এবার মূল্যায়নের পালা। শিক্ষার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়ন করতে হবে। দেখতে হবে যে কাজাটি শিক্ষার্থী করেছে এই কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীর জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও যোগ্যতা কতটুকু অর্জন হয়েছে। এই কাজের সময় শিক্ষার্থীদের পর্যাপ্ত লিখতে হয়না। আবার দলীয় কাজ বিধায় সবাইকে লিখতে হয় না। উপস্থাপন মৌখিক। উপস্থাপন শেষ, ভালো মন্দের প্রমাণও শেষ।
শিক্ষক কোন শিক্ষার্থীর বা দলনেতার উপস্থাপন দেখে মূল্যায়ন সূচক চতুর্ভুজ, বৃত্ত অথবা ত্রিভূজ দিয়ে দিচ্ছেন। কোন শিক্ষার্থী অত্যন্ত ভালো উপস্থাপন করার পরেও শিক্ষকের অপছন্দের শিক্ষার্থী হওয়ার করণে সূচকের নিন্মমান চতুর্ভুজ পেয়ে যেতে পারে। আবার কোন শিক্ষার্থী ভালো উপস্থাপন না করেও শিক্ষকের পছন্দের শিক্ষার্থী হওয়ার কারণে সূচকের উচ্চমান ত্রিভূজ পেতে পারে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা যোগ্যতা অর্জনের চেয়ে শিক্ষকের কৃপা অর্জনে বেশি মনোযোগী হবে। এই ব্যবস্থায় শিক্ষকের রাজনৈতিক দর্শন, ধর্মীয় আদর্শ, জাতীয়তা নীতি, শিক্ষকের মূল্যবোধ শিক্ষার্থীর উপর বিরুপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ফলাফল হাতে পাওয়ার পর সংক্ষুব্ধ যেসব শিক্ষার্থী মনে করবে তাদের যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি, তারা আরো ভালোভাবে কাজটি উপস্থাপন করেছিলো, তারা মূল্যায়নের সময় যথেষ্ট লিখিত উপাদানের অভাবে তা প্রমাণও করতে পারবে না। কিন্তু শিক্ষক তাদের অবমূল্যায়ন করেছেন।
ঘটনাটা ভিন্নও হতে পারে। সমাজে প্রভাবশালী সম্পদায় রয়েছে। কোন কোন প্রভাবশালী তার ক্ষমতা অপব্যবহার করে। কারো কারো অপদার্থ সন্তানও রয়েছে। একজন অত্যন্ত আদর্শবান শিক্ষক, তিনি তাঁর কাজ অত্যন্ত যথাযথভাবে করেছেন। শিক্ষার্থীর যোগ্যাত মূল্যায়ন করে তিনি সূচকের নিন্মমান চতুর্ভূজ দিয়েছেন। সেই শিক্ষার্থী যদি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী প্রভাবশালী ব্যক্তির সন্তান হয় তবে এমনও হতে পারে শিক্ষক বিপদে পড়েছেন। খুব স্বভাবিকভাবে মূল্যায়নে পর্যাপ্ত লিখিত উপাদানের অভাবে শিক্ষক প্রমাণ করতে পারবেন না, শিক্ষার্থী মূল্যায়নের সময় ভালোভাবে কাজটি উপস্থাপন করতে পারেনি।
আমাদের সমাজ বাস্তবতায়, আমাদের সংস্কৃতিতে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের অবিশ্বাসের মুখোমুখি দাড় করিয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। নতুন শিক্ষাক্রম ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের জন্য শাঁখের করাত।
লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব
Comments