নেপালি ছাত্র অর্জুন কুমার কাফলে ছোটবেলা থেকেই অনেক নামডাক শুনেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি)। তাই ২০১৮ সালে নেপাল থেকে ঢাকায় আসেন পড়তে। কিন্তু তার স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে প্রথমেই পড়তে হয় ভোগান্তিতে। ২০১৮-১৯ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হতে গিয়ে তাকে জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়তে হয়। এ দপ্তর থেকে সে দপ্তর, ডিপার্টমেন্ট থেকে হল, হল থেকে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং (প্রশাসনিক ভবন), সেখান থেকে আবার ব্যাংক হয়ে ডিপার্টমেন্ট। এভাবে এ ভবন থেকে সে ভবন ঘোরা, পুলিশ ভেরিফিকেশন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতিসহ যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করতে তার প্রায় চার মাস লেগে যায়।
উপরের এই গল্প শুধু অর্জুনের না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা প্রায় সব বিদেশি শিক্ষার্থীর ভোগান্তির পর্বগুলো প্রায় একই। বর্তমান পদ্ধতিতে, একজন বিদেশিকে প্রথমে বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এবং তারপরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। অনুমোদন পাওয়ার পর, শিক্ষার্থীকে ভর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ করতে হয়। অনলাইনে এসব প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে কমপক্ষে দুই থেকে তিন মাস সময় লাগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিভাগ ও ফ্যাকাল্টিতে ক্লাসরুমে শিক্ষকরা ইংরেজিতে লেকচার দেন। কিন্তু অধিকাংশ বিভাগে ক্লাস লেকচার বাংলায় হওয়ায় বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভাষা বুঝে ক্লাসের বিষয়বস্তু আয়ত্ত করতে বেশ বেগ পেতে হয়।
এ বিষয়ে ঢাবির নেপালি ছাত্র অর্জুন দ্যা বলেন, প্রথম প্রথম ক্লাসে বাংলা বলায় আমি লেকচার বুঝতে পারতাম না। আমি একদিন বিষয়টি এক শিক্ষককে জানালে তিনি আমাকে বলেন এখানে পড়তে হলে অবশ্যই বাংলা শিখতে হবে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে বাংলা আমার আয়ত্তে আসে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো স্কলারশিপ। বেশ কিছু বিভাগে পড়ালেখার খরচ মাত্রাতিরিক্ত বলে দাবি করেন অর্জুন। তার মতে, প্রতিবছর ভর্তির জন্য ৫০০ ডলার খরচ হয়। পাশাপাশি থাকা খাওয়া হল ফিসহ নানা ধরনের খরচ আছে। এখানে কোনো স্কলারশিপের ব্যবস্থা নেই তাই নেপালি মধ্যবিত্তরা চাইলেও এখানে পড়তে আসতে পারবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক ফিলিস্তিনি শিক্ষার্থী জানান, ভর্তির সময় একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া অবলম্বন করলেও পরবর্তীতে আর সমস্যা হয়নি। অধিকাংশ ক্লাস বাংলা এবং ইংরেজি উভয় ভাষা একত্রে ব্যবহার করা হয়। ইংরেজির মধ্যে বাংলা আর বাংলার মাঝে ইংরেজি এভাবেই ক্লাসগুলো হয় তবে ইংরেজি বেশি ব্যবহার করা হয়।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নেই কোনো স্কলারশিপ। বেশ কিছু বিভাগে পড়ালেখার খরচ মাত্রাতিরিক্ত বলে দাবি করেন অর্জুন। তার মতে, প্রতিবছর ভর্তির জন্য ৫০০ ডলার খরচ হয়। পাশাপাশি থাকা খাওয়া হল ফিসহ নানা ধরনের খরচ আছে। এখানে কোনো স্কলারশিপের ব্যবস্থা নেই তাই নেপালি মধ্যবিত্তরা চাইলেও এখানে পড়তে আসতে পারবে না।
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আরেক নেপালি ছাত্র বলেন, বাংলায় লেকচার হওয়ার কারণে আমিও প্রথম কয়েকমাস লেকচার বুঝতে পারিনি। কিন্তু উপায় না থাকায় আমি যত দ্রুত সম্ভব বাংলা শিখে নিয়েছি।
একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় প্রধানত শিক্ষার মান ও সুযোগ সুবিধা দেখে। কিন্তু সেটির কোনো উন্নত প্যাকেজ বাস্তবায়ন না থাকায় বছর বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ডেস্ক ও বিদেশি শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল স্যার পি জে হার্টগ ইন্টারন্যাশনাল হলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাবিতে এই মুহূর্তে মূল শিক্ষাক্রমে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ জন। এছাড়া অধিভুক্ত বিশেষ করে মেডিকেল কলেজগুলোতে রয়েছে আরও ৮৬ জন। অথচ ১০ বছর আগে ঢাবির মূল শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী ছিলেন ২৫ জন। অর্থাৎ ক্রমেই কমে আসছে এই সংখ্যা।
দেশে প্রয়োজনের অধিক সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলাকেও শিক্ষার মান কমে যাওয়ার একটা বড় কারণ হিসেবে দেখেন এই অধ্যাপক। তাঁর মতে, নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে আছে সেগুলোর মান উন্নয়ন করা বেশি জরুরি। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দলীয়করণও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষার উপকরণ ২১ শতকের পঠন-পাঠনের সাথে আপ-টু-ডেট না থাকলে বিদেশি শিক্ষার্থী আসবে কেন!
এক বুক সপ্ন ও আশা নিয়ে পড়তে আসা বিদেশি শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসার পর সুযোগ-সুবিধার তেমন কোনো উন্নত দিক পান না। দেখা যায় বেশ কিছু বিভাগে ক্লাস রুমে এসি নেই। গাদাগাদি করে বসতে হয়। এছাড়া হলে পর্যাপ্ত বিদেশি ক্যান্টিন নেই যেখানে নানা দেশ ও সংস্কৃতির খাবারের আয়োজন থাকবে।
নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় করার চেয়ে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে আছে সেগুলোর মান উন্নয়ন করা বেশি জরুরি। এছাড়া শিক্ষক নিয়োগ ও পদন্নতির ক্ষেত্রে দলীয়করণও একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলে। শিক্ষার উপকরণ ২১ শতকের পঠন-পাঠনের সাথে আপ-টু-ডেট না থাকলে বিদেশি শিক্ষার্থী আসবে কেন
এ প্রসঙ্গে ঢাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শান্তুনু মজুমদার বলেন, আমি মনে করি না ঢাবির পড়াশোনার মান কখনই বিশ্বমানের ছিল। অর্থাৎ আগেও যে খুব বেশি স্টুডেন্ট এখানে পড়তে আসতো ব্যাপারটা এমন না। তবে আমি মনে করি একটা বিদেশি স্টুডেন্টদের আকৃষ্ট করতে হলে যে সঠিক ব্রান্ডিং বা প্যাকেজ উপস্থাপন করা দরকার হয় সেটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাবি করে না। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সাধারণত ব্যাবসায়িক স্বার্থে শিক্ষার্থী পাওয়ার জন্য এটি করে থাকে।
ঢাবিতে বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়ানোর ৩টি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক। তাঁর মতে, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের ইন্টারন্যাশনাল দপ্তরকে আরও বেশি রেস্পন্সিভ হতে হবে ও দ্রুত সময়ের মধ্যে তথ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ঢাবিতে ভর্তি জটিলতা কমানোর ব্যাপারে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রাক্তন বিদেশি শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে তারা যেন তাদের দেশে ফিরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঢাবির ইতিবাচক দিকগুলো ছড়িয়ে দেয়।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি পাওয়া যায় তা হলো গুণগত মানসম্পন্ন কোনো প্যাকেজ ঢাবিতে নেই যা দিয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। যে প্যাকেজে একটি সরল ভর্তি প্রক্রিয়া, যুগোপযোগী শিক্ষা, ও উন্নত লজিস্টিক সুবিধা থাকে সেখানেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কয়েক দশকে ঢাবির এই প্যাকেজের গুণগত মান ক্রমাগত হারে পড়ে গেছে যার ফলে সমানুপাতে কমেছে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
কম্পিউটার সায়েন্স, ফার্মেসি এরা উন্নত সেবা প্রদান করে থাকে। এ ধরনের বিভাগে আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে টাকায় সেবা পায় সেটা তো অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা পাবে না। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও এরকম কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট ৪০০ বা ৫০০ ডলার নিয়ে থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক।
ঢাবিতে বিদেশি শিক্ষার্থীর কমে যাওয়ার ব্যাপারটাতে একমত পোষণ করে উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষার্থীরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের মান দেখে সেখানে পড়তে যায়। কিন্তু আমরা সব রকম সুযোগ সুবিধা শিক্ষার্থীদের এখনো দিতে পারছি না। আমরা কোনো ধরনের স্কলারশিপ দিতে পারছি না। অন্যান্য দেশে শিক্ষার্থীরা স্কলারশিপ পাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অন্যান্য কারণে বিভিন্ন সময় ৩ বছরের কোর্স শেষ হতে সময় লাগে সাত বছর। তাই সব ধরনের নিশ্চয়তা,পড়ালেখার উন্নত মান আমরা দিতে পারছি না। এজন্য আগের থেকে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে।
তবে ভবিষ্যতে ঢাবিতে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করা হবে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, লেখাপড়ার মান আরও উন্নত হবে। আমরা ইতোমধ্যে বাইরের দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আন্তর্জাতিক ডেস্ক তৈরি করেছি। আশা করছি ধীরে ধীরে শিক্ষার্থী বাড়বে।
বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি অতিরিক্ত হওয়ার ব্যাপারে উপাচার্য জানান, কিছু বিভাগ যেমন কম্পিউটার সায়েন্স, ফার্মেসি এরা উন্নত সেবা প্রদান করে থাকে। এ ধরনের বিভাগে আমাদের দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে টাকায় সেবা পায় সেটা তো অন্যান্য দেশের শিক্ষার্থীরা পাবে না। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও এরকম কয়েকটি ডিপার্টমেন্ট ৪০০ বা ৫০০ ডলার নিয়ে থাকে। এটা খুবই স্বাভাবিক।