ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বাস্তববর্জিত এবং একটি সাংবিধানিক ভাষণ দিলেন। বাস্তববর্জিত এ কারণে যে, বাংলাদেশে এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে, তিনি সব রাজনৈতিক দলকে নিয়েই নির্বাচন করতে চান। তো আমার কাছে এটা বাস্তববর্জিত একটি ভাষণ বলে মনে হলো। এই নির্বাচন তিনি করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে আমি শঙ্কিত।
আরেকটি কথা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, শর্তহীন সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য যে কথা বলে আসছে তিন দলকে, তাতে অনেক সময় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, ‘সময় কম’ । তো রাজনীতিতে তো স্বল্পসময় বলে কিছু নেই। যখন-তখন সিদ্ধান্ত হতে পারে, শেষ কথা বলে কিছু নেই।
কিন্তু সংগত কারণেই তফশিল ঘোষণাকে আওয়ামী লীগ স্বাগত জানিয়েছে, আবার বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। এতে রাজনৈতিক সংকটের কোনোই সমাধান হয়নি। রাজনৈতিক সংকট জিইয়ে রেখে যদি নির্বাচনের তফশিল ঘোষিত হয়, সেই তফশিল অকার্যকর হতে বাধ্য। এটা অনিবার্য বলে আমি মনে করি। নির্বাচন কমিশনারের উচিত ছিল সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে, সরকারের দায়িত্ব, সব দলগুলোর দায়িত্ব-রাজনৈতিক সংকট মেটানো। কিন্তু তা না করে তফশিল যেভাবে একপক্ষীয়ভাবে ঘোষণা করা হলো, সেটিকে আমি অযৌক্তিক বলে মনে করছি।
এখানে আরেকটি কথা আছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে মানুষ পোড়ানো হচ্ছে, যা সত্যি, বাসে-গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, তাও সত্যি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এটা নাশকতা, এটা রাজনীতি নয়। বর্তমানে দেশে রাজনীতি আছে বলে আমি মনে করি না। এখন আছে ক্ষমতার নীতি, যারা ক্ষমতায় আছেন, তারা তা দীর্ঘায়িত করতে চান, আর যারা ক্ষমতার বাইরে আছেন, তারা দ্রুত ক্ষমতায় ফিরতে চান। এ হচ্ছে তাদের নীতি। জনগণের আকাক্সক্ষার কথা কেউ বলে না, জনগণের ভোটাধিকার তো নেই-ই। ২০১৪ বা ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ নিজে নিজেকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে এনেছে। তো সেজন্য সমস্যাটা রয়ে গেছে।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণের পরও ১৬ থেকে ২৪ মার্চ ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। এ বার্তাই তারা সারা পৃথিবীকে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন যে, রাজনৈতিক সংকটের সমাধান রাজনৈতিক দলের মধ্য থেকেই হবে। অবশ্য পাকিস্তানিরা সাময়িক সমাধানের জন্য বদ্ধপরিকর ছিল, শেষ পর্যন্ত পারেওনি তারা, হেরে গেছে। আরেকটা কথা, ২২ মার্চ ভুট্টো প্রথম আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। বিরতির সময় বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে লনে নিয়ে গেলেন সুগন্ধায়। গিয়ে বললেন, সংকটটা রাজনৈতিক। যেহেতু দুজনেই আমরা রাজনীতিবিদ, তাই সমাধানটা আমরাই করি। সেনাবাহিনী তো তোমাকেও মারবে, আমাকেও মারবে। ব্যাপারটা সত্যিই হলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভুট্টোকে হত্যা করেছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে।
১৯২৪ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম শ্রমিক দল ক্ষমতাসীন হয়। সেসময় রামসে ম্যাকডোনাল্ড রাশিয়ার স্বীকৃতির ব্যাপারে যখন নিশ্চিত হচ্ছিলেন না, তখন তিনি হাউজ অব কমন্সে বলেছিলেন, মানুষখেকোদের সঙ্গেও যদি আমরা সম্পর্ক গড়তে পারি, তো রাশিয়া তো খুব ছোট ব্যাপার। সেজন্যই রাজনীতিতে এমন সংলাপ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তো মানুষ পোড়ায়, বাসে আগুন দেয়, গাড়িতে আগুন দেয়, এর থেকে বিরত রাখার জন্যই তাদের (বিএনপি) সংলাপে ডাকা উচিত। আওয়ামী লীগেরও উচিত সংলাপে বসা। সংলাপ ছাড়া চলমান রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান আছে বলে আমার মনে হয় না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা ঘটছে, তাতে রাজনৈতিক সংকট মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতোই থেকে যাবে। এতে কিছুই হবে না। বরং আমি যেটা মনে করি, এতে অনাকাঙ্ক্ষিত অরাজনৈতিক সমাধান অনিবার্য হয়ে উঠবে।
ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন : চেয়ার প্রফেসর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)