Image description

সুলতান আহমেদ রাহী: একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের মর্মন্তুদ ও গৌরবময় একটি দিন, যেদিন তাজা রক্তের মূল্যে উচ্চারিত হয়েছিল মাতৃভাষার কণ্ঠস্বর। সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি এবার ফিরে আসছে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং দেশ গড়ার ডাক নিয়ে। মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা এদেশের মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেয় অধিকার অর্জনের গৌরব উজ্জ্বল ইতিহাসের ইতিবৃত্ত। পৃথিবীর একমাত্র জাতি আমরা, যারা নিজ মাতৃভাষা বাংলার জন্য রাজপথে রক্ত দিয়েছি, শত্রুর বুলেট বিদ্ধ হয়ে জীবন উৎসর্গ করে মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্মগত অধিকার আদায় করেছি। 

আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা মাতৃভাষা হিসেবে বিশ্ব-ভাষা তালিকায় পঞ্চম এবং বহুল ব্যবহৃত ভাষা হিসেবে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বজুড়ে ৩০ কোটির বেশি মানুষ বাংলা কথা বলে, যার মধ্যে প্রায় ২৬ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষা ব্যবহার করেন বাংলাদেশ ও ভারতে। বাকি চার কোটি মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে আছেন বাংলা ভাষাকে সম্মানের সঙ্গে হৃদয়ে আঁকড়ে ধরে। কারণ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা বাঙালির জাতিসত্তা ও ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্রের প্রতীক।

আমাদের মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর উত্তম) একজন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হিসেবে জাতীয়তাবাদকে প্রবলভাবে ধারণ করতেন। আমরা বাঙালি; বাংলা ভাষা আমাদের জাতীয়তাবাদের অপরিহার্য উপাদান, এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণের প্রতি পাঞ্জাবিদের বিরূপ মনোভাবের কড়া সমালোচনা করতেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভের আগে জিয়াউর রহমান কুমিল্লা সেনানিবাসে সেনাবাহিনীর শীতকালীন মহড়ায় অংশগ্রহণ করেন। নির্দেশনা অনুযায়ী মহড়ার সময় এক কৃষকের গোয়ালঘরে লুকিয়ে ছিলেন। রাত শেষে সকালে প্রচণ্ড পিপাসা পেলে তিঁনি কৃষকের কাছে পানি খেতে চাইলেন। কৃষক দৌড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন এবং উর্দুতে বললেন, "লিজিয়ে হুজুর, পানি লিজিয়ে।" এই কথা শুনে জিয়াউর রহমান দুঃখ পেলেন। তিনি পানি চেয়েছিলেন বাংলায়। কৃষক জানতেন, জিয়াউর রহমান বাঙালি সেনা কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি উর্দুতে কথা বলায়, জিয়াউর রহমান পিপাসিত থাকলেও কৃষকের দেওয়া পানি পান করলেন না। কৃষকের এই মনোভাব দেখে তিনি রাগ্বানিত হয়ে হাতের তালু দিয়ে চপেটাঘাত করে কৃষককে বললেন, "আমি আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বললাম, আর আপনি আমার সঙ্গে উর্দুতে কথা বললেন কেন? এত পা চাটা স্বভাব কেন আপনাদের?" কৃষক ভীত হয়ে পড়লে, জিয়াউর রহমান নিজেও লজ্জিত হন। পরে তিনি কৃষকের হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে বলেন, "আপনার উর্দু শুনে রেগে গিয়েছিলাম, দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিন।"

শহিদ জিয়াউর রহমান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে প্রবলভাবে ধারণ করতেন। কারণ তাঁর রাজনৈতিক দল বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা ও তাঁর সরকার পরিচালনায় ছিলেন দেশপ্রেমিক, সৎ, যোগ্য, মেধাবী এবং পরিশ্রমী ব্যক্তিরা। উনাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভাষা আন্দোলনের বীর সৈনিক ও মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা। এজন্য বিএনপিকে মুক্তিযোদ্ধাদের দল হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।

পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে ভাষা শহিদদের স্মরণে ১৯৭৬ সালে মহান স্বাধীনতার ঘোষক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান (বীর  উত্তম) প্রথম একুশে পদকের প্রচলন করেন। একুশে পদক বাংলাদেশের একটি জাতীয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার।

এবারের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এমন এক সময় এসেছে, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট করার জন্য আধিপত্যবাদী শক্তিগুলো সক্রিয়। তাদের সঙ্গে রয়েছে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য শত্রুরা, যারা ক্ষমতার লোভে নিজেদের জাতির বিরুদ্ধে চক্রান্তে লিপ্ত। আগ্রাসী শক্তি বাংলাদেশের জাতিসত্তা, স্বকীয়তা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নষ্ট করতে চায়।বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে। দেশবিরোধী অপশক্তি, আধিপত্যবাদী শক্তির মদদপুষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনা থেকে শিক্ষা নিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ ধরে দেশ ও জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

৭৩ বছর আগে পাকিস্তানি শাসকেরা আমাদের মাতৃভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য কেড়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করে, আমাদের বীর ভাষা সৈনিকরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার  অধিকার রক্ষা করেছিলেন।

বর্তমানেও বিদেশি শত্রুরা এবং দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করছে। বিগত ১৭ বছর ধরে গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের শাসনামলে জনগণের ভাগ্য নিয়ে নিষ্ঠুর খেলা হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, বিভ্রান্ত করা হয়েছে জাতিকে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুটপাট ও বিদেশে পাচার করা হয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার ও মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

এই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে বিএনপি চেয়ারপারসন, আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জনাব তারেক রহমান দেশের আপামর জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হবার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে। তাঁরা দলের নেতাকর্মীদের জনগণের সুখ-দুঃখ ও বিপদে-আপদে পাশে থেকে সর্বদা জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। বিএনপি বিশ্বাস করে; সততা, আদর্শ ও দেশপ্রেমের সমন্বয়ে নতুন এক মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক ও জাতীয় পরিচয়কে সুসংহত করে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে স্বনির্ভর বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। বিএনপি দেশের মেধাবী, পরিশ্রমী, সৎ, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক মানুষদের নিয়ে নতুন মানবিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে চায়। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপি রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ৩১ দফা রূপরেখা ঘোষণা করেছে, যা ১৮ কোটি মানুষের সমর্থন নিয়ে বাস্তবায়ন করতে চায়।

মহান একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা হবে আমাদের দেশ গড়ার অন্যতম প্রেরণা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জীবন উৎসর্গকারী শহিদ সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউলসহ সকল ভাষা শহিদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং সকল বীর ভাষা সৈনিকদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও সম্মান।

লেখক: আহ্বায়ক, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।